স্কুলবাস এর জানালায় চোখ রেখে বাইরেটা দুচোখ ভরে দেখে নিতে নিতে ছোট্ট মুনিয়ার মনে কত ভাবনা ওড়াউড়ি করে। একদম ওই রঙিন ঘুড়িগুলোর মতো – সার দিয়ে রাখা আছে দেখো! ক’দিন পরেই ওগুলো সবার হাতে হাতে ঘুরে উড়ান দেবে সাদা মেঘ ভরা নীল আকাশে – সব বাধা পেরিয়ে। লাটাই ধরা উন্মুখ হাতের টানে এপাশ – ওপাশ ওড়াউড়ি করে ঘুড়িগুলো একে অন্যকে টেক্কা দেওয়ার খেলায় মেতে উঠবে।
মুনিয়ার খুব ভাল লাগে এই সময়টা এলেই। বিশ্বকর্মা ঠাকুর যেন পুজোর খবর নিয়ে আশা দূত, আর বেশি দেরী নেই মা দুর্গার আসার – জলদি জলদি হাত চালাও সব। পান্ডালের কাঠামো সেই কবে থেকে বাঁধা হচ্ছে – এবার তাড়াতাড়ি তাতে সাজসজ্জার রঙিন পরত পড়তে শুরু করেছে। পটুয়াপাড়ায় হইচই পড়ে গেছে – মূর্তিরা একে একে পরিণতিপ্রাপ্ত হচ্ছে। সাজসজ্জার বাহারে ঝলমল করছে চারদিক। মুনিয়ার বাড়িতে দু’দুটো শিউলি ফুলের গাছ – একজন বেশ বুড়ো, অন্যজন সেই তুলনায় জোয়ান, উঠোন আলো করে দাঁড়িয়ে আছে। সকালে বাড়ীর সদর দরজা খুললেই ঝলকে ঝলকে মিষ্টি গন্ধ নাকে ঝাপটা দেয়।
ছুটির দিনে ঠাকুমার জন্য পুজোর ফুল তোলার সময় মুনিয়া পায়ের তলায় শিউলি ফুলের গালিচা মাড়িয়ে চলে – এত্ত ফুল যে চাইলেও ওদের বাঁচিয়ে বাগানে যাওয়া অসম্ভব। অনেক কায়দা করে এক কোণা থেকে ফুল কুড়োতে কুড়োতে এগিয়ে যেতে হয় মুনিয়াকে ফুলে পা দেওয়া এড়াতে। সাজি ভরে ওঠে, তাও ফুলের গালিচা পড়ে থাকে সুগন্ধ নিয়ে। পাড়ার মেয়ে-বউরাও আসে – নিয়ম করে, আগে ঠাকুমার ফুল তোলা হলে তবে বাকীদের সুযোগ। সকালে একটু ভেজা থাকে ফুলগুলো – মনে মনে মুনিয়া কল্পনা করে নিশ্চই ঝরে পড়ার সময় খুব কেঁদেছে ফুলগুলো। ঠাকুমা বুঝিয়েছে যে অল্প শিশির পড়া শুরু হয়েছে – তাই ওরকম ভিজে ভাব, মুনিয়া যেন মন খারাপ না করে অন্য কিছু ভেবে।
স্কুলবাস এর হেল্পার – মহেশদার ডাকে চটকা ভাঙ্গে মুনিয়ার – স্কুল এসে গেছ। ধড়াম করে কল্পনার জগত থেকে বাস্তবে এসে পড়ে মুনিয়া। তারপর আর কি – সারাদিন পড়াশুনোর পরে আবার কল্পনার জগতে ভেসে স্কুলবাসে করে বাড়ি ফেরা।
দেখতে দেখতে পুজো এসে যায়। প্রতিবছর মাসী-মামা-পিসি-কাকা-জ্যাঠারা জামার ছিটকাপড় দেন মুনিয়ার জন্য – তাই দিয়ে মা সেলাই মেশিনে কত বাহারি জামা বানিয়ে দেন। এবার আটটা জামা হয়েছে। পুজোর কদিন হইচই, ঠাকুর দেখা, হাওয়াবন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটানো, তুতো-ভাইবোনেদের সাথে বেড়ানো, পুজোর মেলার স্টল থেকে খাওয়া দাওয়া করে হুশ্ করে বেড়িয়ে যায়। মুনিয়া বুঝতেই পারে না পুজোর এই ক’টা দিন কি করে এত তাড়াতাড়ি পার হয়ে যায়। মনে মনে সন্দেহ হয় এই দিনগুলো কি সত্যি ২৪ ঘন্টার, না কি? কোনও মনকষাকষি নেই, সারা বছরের মান-অভিমান সব শিকেয় তোলা থাকে এই ক’দিন। আশ্চর্য যে, ভাইবোনদের স্বাভাবিক ঝগড়াও উধাও। সবাই এক পরিবার হয়ে আনন্দে মেতে ওঠা – যেন কোনো এক অলীক কল্পনার বাস্তবায়িত হয়ে ওঠা। মুনিয়া ভাবে প্রত্যেক পুজো শেষে – ‘আহা! এমনই কেন সারা বছর থাকে না সবকিছু’।
দিন আসে, দিন যায় – মাস গড়িয়ে বছর হয়। সেই মুনিয়া এখন প্রবাসী – বিবাহসূত্রে সিঙ্গাপুর বাসী। খুব কষ্ট হয়েছিল মা-বাবাকে ছেড়ে এতদূর আসতে। পুজো কখন আসে, কখন যায় – বোঝা দায়, সেই আনন্দও আর বিশেষ পাওয়া যায় না। সেই আন্তরিকতার ছোঁয়া নেই যেন।
দীর্ঘ সময় পর, প্রৌঢ়ত্বে এসে, একবার একটা নতুন শুরু হওয়া পুজোতে গিয়ে একঝলক সেই ফেলে আসা পুজোর আমেজ পেলো। সন্দিহান মনে, সাবধানী পদক্ষেপে একটু এগিয়ে দেখলো – নাহ্! ঠিকই মনে হচ্ছে। মেকি নয়, বরং বেশ পারিবারিক একটা আবহাওয়া বোধ হচ্ছে। আজ তৃতীয় বছরে সেই পুজোতে যোগদান করে মুনিয়া সত্যি আনন্দিত। অনেক ও অনেকের ত্যাগ স্বীকার করা, মেনে ও মানিয়ে চলার শিক্ষাই বোধহয় এই সার্বজনীন উৎসবের মূলে। সিপা (SIPA) কে ধন্যবাদ, আপ্রাণ চেষ্টা করে সার্বজনীন আবহাওয়াটা ধরে রাখার জন্য আর এই আন্তরিক প্রয়াসের জন্য।