#

Expressions

দূর্গা পূজা ও সাহিত্য
- Shyamoli Laha

বাঙালির ১২ মাসে ১৩ পার্বণ আর তার মধ্যে অন্যতম হলো দূর্গা পুজো। দূর্গা পুজোকে নিয়ে কত কাহিনী কত ইতিহাস ঘুরে বেড়ায়,তার কিছু জানা কিছু অজানা আমাদের। আসলে শিক্ষা এবং সাহিত্যে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। তাই সেই সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে যুগে যুগে এত কাহিনীর প্রচলন ঘটেছে। আশ্বিন মাস কিংবা শরৎকাল এলে বাঙালির মন খুশিতে ভরে যায়, চারদিকে উৎসব এর জোয়ার। তবে এই উৎসবের সুচনা হয় যার হাত ধরে তার নাম পূজাবার্ষিকী। প্রতিটা বাঙালির ঘরে ঘরে শোভা পায় এই পূজাবার্ষিকী।। পুজো এলো মানে আগেই যতগুলো পারা যায় পূজোসংখ্যা সংগ্রহ করা চাইই চাই। আসুন আজ আলোচনা করা যাক এই পূজোসংখ্যার ইতিহাস ভূগোল।

আজকের প্রজন্মের কাছে হয়তো একটু অচেনা লাগলেও জেনে রাখা ভালো এই পুজো সংখ্যা শুরুর সৃষ্টির ইতিহাস। বাঙালি জাতি শিল্প- সাহিত্য সৃষ্টির জাতি। বিদ্যাসাগর থেকে হুমায়ুন কবির বারবার তাদের সৃষ্টি দিয়ে আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন। দূর্গা পুজো নিয়ে বিশেষ এই সংখ্যার প্রকাশ শুরু হয় আনুমানিক ১৮৭২ সালে। ‘সুলভ সমাচার’ নামক একটি সাপ্তাহিক খবরের কাগজের সম্পাদক কেশব চন্দ্র সেন তার প্রথম শারদসংখ্যা প্রকাশ করেন ইংরেজিতে। নাম দেন 'ছুটির সুলভ’। সেই সময় এর মূল্য ধারণ করা হয় ১ পয়সা। তার দেখাদেখি আরো কিছু সংবাদ সংস্থা যেমন :- ভারতবর্ষ, বঙ্গবাণী, এমনকি আনন্দবাজারও তাদের পূজা সংখ্যা শুরু করে দিল।

এই শারদ সংখ্যা , তৎকালীন নব লেখক সমাজের কাছে একটা খুশির খবর বয়ে নিয়ে এল। যাদের কাছে নিজস্ব বই ছাপানোর মতো অবস্থা ছিলনা, তাদের জন্যে এই শারদসংখ্যা হয়ে উঠলো অশ্বিনের ঘ্রানের মতোই মধুর। প্রথম জীবনে দ্বিজেন্দ্র লাল রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, এমনকি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো লেখকের হাতে খড়ি হয়েছিল এইসব শারদ সংখ্যার হাত ধরেই।

যদিও বা ‘ছুটি সুলভ’ প্রথম শারদীয়া পত্রিকা তবে বাঙালি এর প্রথম স্বাদ পায় সাধনা নামের একটি পত্রিকার মাধ্যমে। সাধনার প্রথম প্রকাশ সাল আনুমানকি ১৮৯১ ডিসেম্বর। তার এক বছর পর অর্থাৎ ১৮৯২ সালের ভাদ্র - আশ্বিন সংখ্যাকে তারা শারদীয়া সংখ্যা হিসেবে বাজারে নিয়ে আসে ।

শোনা যায় সেই সংখ্যার সম্পাদকীয় ভার নিজ কাঁধে তুলে নেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এমনকি নিয়মিত এই পত্রিকায় ছোটো গল্প লিখতেন তিনি। ইতিহাসে আজ অবধি সেই পত্রিকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেরে ওঠেনি কোনো পত্রিকা। কবি গুরুর সেই অপার কাল্পনিক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক সব সৃষ্টি যা আজও পাঠক মুগ্ধ হয়ে পাঠ করে, তার সামনে বারবার মাথা নত করেছে , অনুপ্রেরণা হয়েছেন কত শত লেখক, কবির। ১৯১৮ সালে নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রকাশ করলেন প্রথম পূজা বার্ষিকীসংখ্যা পার্বতী। নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে মীরা দেবীর স্বামী । এই পত্রিকা এবং দুর্গাপুজো কে উৎসর্গ করে কবি লিখলেন, “শরৎ এ আজ কোন অতিথি এলো প্রাণের দ্বারে”।

১৯২৬ সালে পত্রিকাতে প্রথমবার প্রকাশিত হলো উপন্যাস। মানিক বন্দোপাধ্যায় এর ‘শহরতলি’, রবি ঠাকুরের 'রবিবার’ কিংবা ’ল্যাবরেটরি’-র মতো উপন্যাস ও পরবর্তীকালে ছেপে বের হয় বসুমতি পত্রিকা থেকে।। দেশ পত্রিকা তার প্রথম শারদ সংখ্যা প্রকাশ করে ১৯৩৪ সালে। সুবোধ ঘোষের প্রথম উপন্যাস ‘ত্রিযামা’ প্রকাশ করেন এই দেশ পত্রিকা থেকেই। শুরুর দিকে একটি পত্রিকাতে একটি উপন্যাস ছাপার প্রচলন থাকলেও ১৯৬০ সালের দিক থেকে প্রকাশ করা একাধিক উপন্যাস ছাপার আগ্রহ দেখতে পাওয়া যায়।। প্রথম সারির লেখকদের আঙিনায় ভিড় জমতে শুরু করলো প্রকাশকদের। একইভাবে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর মতো লেখকেরা উপন্যাসের পাহাড় নিয়ে হাজির হলেন আমাদের সামনে এইসব শারদসংখ্যার মাধ্যমে। সময়ের সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে সেই পতাকা তুলে দিলেন তারা। শুরু হলো সুনীল শক্তি শ্যামল এর যুগ। সারি দিয়ে মনে পড়ে বিমল কর, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী,রমাপদ চৌধুরী কিংবা সমরেশ বসুর নাম। সময় পাল্টায় ,সমাজ পাল্টায়,পাল্টায় লেখনীর ধারা। সমাজ লেখার ধরণ পাল্টে দিলো নাকি লেখার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সমাজ পাল্টাতে শুরু করলো এর উত্তর কারোর জানা নাই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর কাকাবাবু, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের এর ব্যোমকেশ কিংবা সত্যজিৎ রায় এর কলম থেকে বেরিয়ে এলো ফেলুদার মতো রহস্যময় সব কালজয়ী গল্প, আরও একজনের নাম না করলে নয়, সমরেশ মজুমদার।। যার কলম থেকে প্রকাশিত হলো কালবেলার মতো উপন্যাস।

#

এইসব লেখকদের পাশাপাশি উঠে এলেন আরো অনেক ছোটো বড় লেখক। পুজো সংখ্যায় নিজের নাম দেখতে পাওয়া এক সম্মানের কারণ হয়ে দাঁড়ালো ধীরে ধীরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন এল। বাঙালির দূর্গা পুজো কেবল সাহিত্য চর্চার সীমা পার করে পৌঁছে গেল আকাশবাণীতে। কানে ভেসে এলো আগমনীর মতো চন্ডীপাঠ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মহাশয়ের কণ্ঠে মহালয়ার ভোরে। থেমে থাকলোনা ক্যাসেট কোম্পানিগুলোও। সন্ধ্যা, মান্না, আরতির কণ্ঠে বেজে উঠলো পুজোর গান। কালজয়ী সব লেখকদের লেখার উপর তৈরী হতে শুরু করলো বাংলা সিনেমা, যা মুক্তি পেলো দূর্গা পুজোকেই কেন্দ্র করে।। খুলে গেল সাহিত্য চর্চার আরো নানান দিক।

বর্তমানে স্মার্ট ফোন এর যুগে এইসব ম্যাগাজিন কিনে ঘর ভরতে চায়না হয়তো অনেকে, কাগজের বই এর থেকে মানুষ বেশি পছন্দ করে ই-ম্যাগাজিন। কারণ সেটা বইতে ওজন কিংবা জায়গা দুটোই লাগেনা। তবে এত কিছুর মধ্যেও পুজো সংখ্যার চাহিদার অভাব কমে না। নতুন প্রজন্ম বয়ে নিয়ে চলুক ধারা। 'সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে'। -এস ওয়াজেদ আলী